ল্যাক্টোজ ইনটোলারেন্স
■ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স কি?
এটি এমন এক সমস্যা যেখানে আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ল্যাক্টেজ নামক এনজাইম উৎপাদিত হয় না।।এই এনজাইম এর কাজ হল দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার এর মধ্যে থাকা ল্যাকটোজ-কে ভেঙে এটি দুই ধরনের সুগার তৈরি করে- গ্লুকোজ এবং গ্যালাক্টোজ। মানবদেহ তখন এই সুগার-গুলোকে শোষণ করে আমাদের শরীরে থাকা ইন্টেস্টাইন এর সাথে মিশিয়ে দেয়। যখনি এই ল্যাক্টেজ এনজাইম-এ ঘাটতি দেখা দেয়, এটা আর ঠিকমতো ল্যাকটোজ-কে ভাঙতে বা শোষণ করতে পারে না। তখনি দেখা দেয় ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স। সব থেকে চিন্তার বিষয় হল, কোনও ওষুধের মাধ্যমে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের চিকিৎসা সম্ভব নয় (What is Lactose Intolerance?)। এক্ষেত্রে তাই দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলতে হয়। কিন্তু তাতে করে আরেকটা সমস্যা হয় যা হল শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব। দুধ হল ক্যালসিয়ামের মূল সোর্স। তাই এক্ষেত্রে এমন খাবার খেতে হবে, যাতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। কারণ, দেহে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমতে শুরু করলে ব্রেনের ক্ষমতা কমে যায়, সেই সঙ্গে নানা ধরনের হাড়ের রোগও মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বিশেষ করে Osteoporosis-এর মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
■ ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স / মিল্ক অ্যালার্জি কি ?
না, দুটো এক নয়। অনেক বাবা-মা’ই দুটোকে গুলিয়ে ফেলেন। ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হল হজমগত সমস্যা। আর মিল্ক অ্যালার্জি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় কোন সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে। তাই দুটো এক নয়।ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স মারাত্মক কোন সমস্যার দিকে ঠেলে দেয় না। মিল্ক অ্যালার্জির ঠিক মতো চিকিৎসা না হলে তা ‘অ্যানাফিলেক্টিক শক’ নামে প্রাণঘাতী অসুখের কারণ হতে পারে। তাই যদি দেখা যায় যে দুধ বা দুধের তৈরি কোন কিছু খেলেই বাচ্চার ঠোঁট ফুলে গেছে চুলকাচ্ছে- তাহলে বুঝতে হবে ওটা মিল্ক অ্যালার্জি ।
মিল্ক অ্যালার্জি থাকলে সাধারণত তা শিশুর প্রথম বছর থেকেই বোঝা যায়। কিন্তু ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স সাধারণত শিশুদের একদম জন্ম থেকেই হচ্ছে, এমনটা অপেক্ষাকৃত কম দেখা যায়।
■ প্রকারভেদ
1. প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স
সাধারণত, একটু বড় হবার পর বা কৈশোরে এই সমস্যা ধরা পড়লে, একে প্রাইমারি ল্যাক্টোজ ইন্টলারেন্স বলে। সাধারণত প্রাইমারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-টাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, যেখানে ল্যাক্টেজ শরীরের সাথে প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে আসে।
2. সেকেন্ডারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স
সেকেন্ডারি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-এর বেলায়, অনেক সময়ে কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাল ইনফেকশন, সার্জারি বা দীর্ঘ অসুখের পর শরীরে দুধ সহ্য হয় না।
3. জন্মগত ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স
এমনটা খুবই বিরল সমস্যা যে বাচ্চা জন্ম থেকেই দুধ একদম সহ্য করতে পারছে না বা খেলেই যন্ত্রণা পাচ্ছে, ডায়রিয়া হয়ে যাচ্ছে বা বমি করে ফেলছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, তার জন্য দায়ী হল জীনগত সমস্যা। বাবা বা মায়ের কাছ থেকে এই সমস্যা বংশগত ধারায় বাচ্চাও পেয়ে থাকে, ফলে শিশুর শরীরে ল্যাক্টেজ হরমোন থাকে পুরোপুরি অনুপস্থিত। মায়ের দুধে অনেক বেশি ল্যাকটোজ থাকে আগেই বলেছি, এমনকি ল্যাকটোজযুক্ত ফর্মুলা খেলেও বাচ্চা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। এই ধরনের ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে যখন ডায়রিয়াজনিত পানিশূন্যতা এবং ইলেক্ট্রোলাইট-এর ভারসাম্যহীনতার কারণে শিশুর জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে।
4. বিকাশগত ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স
আরেকটা কারণে ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স হতে পারে, তা হল শিশু যদি প্রিম্যাচিওর হয়। সাধারণত শরীরে ল্যাকটেজ এনজাইমা তৈরি হয় মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় ৩৪ সপ্তাহ বয়স থেকে। সেটা ব্যাহত হলে পরবর্তীতে এদের মাঝে ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স-এর প্রবণতা দেখা দেয়।
■ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স-এর কারণ
1. সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর দুধেই ল্যাকটোজ থাকে। পাকস্থলীতে এই ল্যাকটোজ ঠিক মতো হজম হওয়ার জন্য প্রয়োজন ল্যাকটেজ উৎসেচক। এই উৎসেচক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে কম উৎপাদিত হলে দেখা দেয় ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স।
2. খাবার হজম হয় অন্ত্রে। অন্ত্রে কোনও সমস্যা থাকলে তা থেকেও ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স দেখা দিতে পারে। অনেক সময়, রোটা ভাইরাসের
সংক্রমণের ফলে যখন ডায়রিয়া হয়, সে সময় অন্ত্রের হজমক্ষমতা কমে যায়। যার ফলে দুধ জাতীয় খাবার খেলে তা ঠিক মতো হজম হয় না।
3. বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স দেখা যায়। চিকিৎসকরা এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি রোগের কথা বলে থাকেন যেমন ক্রোন’স ডিজিজ, সিলিয়াক ডিজিজ ইত্যাদি। ছোট্ট খুদে এই সমস্যাগুলোয় আক্রান্ত হলে ওর শরীরে ল্যাকটেজ উৎসেচকের উৎপাদন প্রয়োজনীয় মাত্রার তুলনায় অনেকটা কমে যায়। যার ফলে দুধ বা দুধজাত অন্য খাবার ছোট্ট খাদ্যতন্ত্রে ঠিক মতো হজম হয় না।
4. অনেকসময় দেখা যায়, শিশুর মধ্যে ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স-এর সমস্যা এসেছে জিনের মাধ্যমে। বাবা-মা ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের কারও মধ্যে এই সমস্যা রয়েছে কি না, তা থেকে এটা বোঝা যায়। জিন গঠনের সময় কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের মতো এটিও সন্তানের জিনে বাহিত হতে পারে।
■ প্রতিকার
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের জন্য কোনও ওষুধ নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ল্যাকটোজযুক্ত খাবার খাওয়া কমানো বা পুরোপুরি এড়িয়ে চলাই একমাত্র এই অবস্থার উন্নতি করতে পারে।
● প্যাকেট খাবারের লেবেল পড়ার অভ্যাস করতে হবে
যদি শিশুর ল্যাকটোজ অসহীয়তা খুব বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে, তাহলে সব সময় শিশুকে যে খাবারটি কিনে খাওয়াতে চাইছেন, তার লেবেল পড়ার অভ্যাস করতে হবে। কেননা দুধ, পনির, আইসক্রিম ইত্যাদি ছাড়া অন্য খাবারেও ল্যাকটোজ থাকতে পারে। তাই খাবারের প্যাকেটে লেখা উপাদানগুলো ভালো করে পড়ে দেখতে হবে তাতে কেসিন, ল্যাকটোজ, দুধ ইত্যাদি আছে কি না। যদি থাকে তবে তা শিশুকে খাওয়ানো যাবে না।
● শিশুর ওষুধের উপাদানগুলো জেনে নিতে হবে
অনেক ওষুধে ল্যাকটোজ থাকে। তাই শিশুকে তার প্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়ানোর আগে অথবা ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনার আগে অবশ্যই লেবেল পড়ে দেখে নিতে হবে তার মধ্যে ল্যাকটোজ আছে কি না।
● ল্যাকটোজের পরিমাণ কম আছে এমন সব খাবার শিশুর জন্য বাছতে হবে
দুধে ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশি থাকায় তা শিশুর হজমে বেশি অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে। অন্যদিকে পনিরে ল্যাকটোজের পরিমাণ বেশ কিছুটা কম থাকে। আইসক্রিমে মাঝামাঝি পরিমাণের ল্যাকটোজ থাকে। ঘরে তৈরি দইয়ে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া নিজেই দইয়ের অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়া হজম করে রাখে। তাই সেটি খেলেও শিশুর অসুবিধা মোটামুটি কম হবে। শিশুর ল্যাকটোজ সহনশীলতার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে শিশুর জন্য সঠিক খাবার নির্বাচন করতে হবে।
■ করণীয় -
1. দুগ্ধজাত খাদ্য এড়িয়ে চললে পুষ্টির অভাব হতে পারে। তাই, তার পরিবর্তে স্বাস্থ্যকর বিকল্প খোঁজা দরকার।
2. চিজ হয়তো খাদ্যতালিকায় থাকতে পারে, কারণ দেখা গেছে যারা ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্সে ভোগেন তারা অনেক সময় চিজ ভালোই সহ্য করতে পারে।
3. মাখন এবং ক্রিমের ক্ষেত্রেও এক ব্যাপার যেহেতু তাতে ল্যাকটোজের মাত্রা কম। প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য পূরণের জন্য দইও সাহায্য করতে পারেন যেহেতু দইয়ে থাকা ব্যাক্টেরিয়া ল্যাকটোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
4. সয়া জাতীয় খাদ্য যেমন সয়া দুধ সাধারণত দুগ্ধজাত দ্রব্র্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যদিও, সয়ার খাবার দুধের সমান পুষ্টিকর মাত্রা প্রদান করে না।
■ কি কি খাওয়া যাবে -
ল্যাকটোজ ফ্রি মিল্ক, সয়ামিল্ক, আমন্ড মিল্ক, ফলের রস, লেটুস পাতা, ব্রকলি, কমলা লেবু, বাদাম, সামুদ্রিক মাছ, কাঁটাসহ ছোট মাছ, শুঁটকি মাছ, সর্ষে শাক, সব ধরনের ডাল, ধনিয়াপাতা, সাজনা পাতা, পোস্ত দানা, কুমড়ার বিচি, সিমের বিচি, শালগম, কদবেল, খেজুর ও মিনারেল ওয়াটার-এসব কিছু ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার।
ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স থাকলে বিভিন্নভাবে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করলে সুফল পাওয়া যাবে।
■ টিপস -
* যতটুকু দুধ খাওয়ার কথা, তার অর্ধেক পরিমাণ খেতে হবে।
* দুধের সঙ্গে খেতে হবে রুটি, মুড়ি, বিস্কুট, পাউরুটি, চিড়া, খই, সেমাই, সুজি, সাবু ইত্যাদি।
* শিশুদের সয়া দুধের সঙ্গে গ্লুকোজ মিশিয়ে দিলে ভালো হয়।
* দুধের সঙ্গে কোকো মেশালে দুধের ল্যাক্টোজ ভেঙে যায় , সেক্ষেত্রে অসুবিধা হয় না।
* দই বা ঘোল হজম করতে সহজ কারন এতে ল্যাকটিক এসিড থাকে।
বড়দের ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ ইনটোলারেন্স একবার দেখা দিলে তা সারা জীবনের জন্যই রয়ে যায়। তবে শিশুদের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা সাময়িক ভাবে দেখা দেয়।তবে এ ধরনের অসুবিধা কয়েক মাস পর্যন্ত থাকতে পারে।ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে ল্যাকটোজ ইনটোলারেন্স দেখা দিলে তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে তার তত্ত্বাবধানেই রাখতে হবে।
Comments
Post a Comment