UTI ইনফেকশন হলে কি করবেন?

মূত্রনালির সংক্রমণ বা ইউটিআই (UTI) হল মূত্রনালির এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ। এই ব্যাকটেরিয়া মূত্রনালী থেকে শুরু করে পৌঁছে যেতে পারে কিডনি (Kidney) ও ব্লাডারে (Bladder)। তাই প্রতিটি মানুষকে অবশ্যই হতে হবে সবধান।যখন এর ফলে মূত্রনালির নিম্নাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে মূত্রথলির সংক্রমণ (বা সিস্টাইটিস) বলে আর যখন এর ফলে মূত্রনালির ঊর্ধ্বাংশ আক্রান্ত হয়, তখন তাকে কিডনির সংক্রমণ (বা পায়েলোনেফ্রাইটিস) বলে।
প্রতিবছর প্রায় ১৫ কোটি মানুষ মূত্রনালির সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে এই সংক্রমণে বেশি দেখা যায়।নারীদের ক্ষেত্রে এ সংক্রমণ প্রধানত ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়।প্রতি বছর প্রায় ১০% নারীর মূত্রনালির সংক্রমণ হয় এবং অর্ধেক সংখ্যক নারীই জীবদ্দশায় অন্তত একবার হলেও এই সংক্রমণের শিকার হন। ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সে এ সংক্রমণ বেশি হয়।

■ কেন হয় এই সমস্যা?
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা অনেক বেশি দেখা যায়। কারণ মেয়েদের মূত্রনালী জন্মগতভাবে পুরুষদের তুলনায় ছোট এবং মলদ্বারের খুব কাছাকাছি। তাই ব্যাকটেরিয়া খুব সহজেই আক্রমণ করে এবং জীবাণু মূত্রথলি এবং কিডনির উপর প্রভাব বিস্তার করে।
১. ইস্ট্রোজেন মূত্রনালির সংক্রমণে বাধা দেয়। মেনোপজ-এর পর ইস্ট্রোজেন-এর ক্ষরণ কমে যায়। ফলে সংক্রমণের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
২. অনেকক্ষণ প্রস্রাব আটকিয়ে রাখলে সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। TV দেখার সময়, বাসে ট্রেনে যাতায়াত করার সময় বা জরুরী মিটিং-এর সময় অনেকেই প্রস্রাব আটকিয়ে রাখেন যা একদমই উচিত নয়।
৩. যৌনসঙ্গীর ইউটিআই থাকলে শারীরিক মিলনের সময় অন্য সঙ্গীও সংক্রমিত হতে পারে।
৪. পারসোনাল হাইজিন মেনে না চললে ইউটিআই হতে পারে।
৫. যদি কারো কিডনি অথবা মুত্রথলিতে পাথর থাকে তবে তা স্বাভাবিক মূত্রত্যাগে বাধা দেয়। এর ফলেও ইনফেকশন হতে পারে।
৬. ডায়াবেটিস, প্রেগন্যান্সি বা অন্য কোন রোগে যদি রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে থাকে তাহলে ইউটিআই হতে পারে।
৭. অনেক সময় অপারেশনের আগে বা পরে রোগীদের ক্যাথেটার পড়ানো হয়। বেশিদিন ক্যাথেটার পরানো থাকলে খুব সহজেই ইউটিআই হতে পারে।
৮. এছাড়াও যারা দীর্ঘ দিন ধরে  পাবলিক টয়েলেট ব্যবহার করে তাদের সম্ভাবনা থাকে।

■ লক্ষণ : -
১| বারবার প্রস্রাব পাওয়া এবং খুব বেশি প্রস্রাব হবে বলে মনে হওয়া কিন্তু সে তুলনায় খুবই অল্প হওয়া
২| প্রস্রাবের রঙ বদলে যাওয়া
৩| প্রস্রাবে দুর্গন্ধ হওয়া
৪| অনেকসময়েই প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া
৫| প্রস্রাব করার সময়ে যোনিপথে অত্যন্ত জ্বালা (Symptoms)
৬| বমি বমি পাওয়া এবং কোনও কোনও সময়ে বমি করা
৭| সারা শরীরে ব্যাথা এবং তলপেটে মাঝেমাঝেই যন্ত্রণা হওয়া
৮| জ্বর হওয়া

■ কী উপায়ে এই অসুখ থেকে দূরে থাকা যায়:-
১. নিয়ম মেনে শরীরে যতটা জলের প্রয়োজন, ততটাই খেতে হবে। যত বেশিবার মূত্র নির্গত হবে, ততই শরীর থেকে টক্সিন বার হবে। এতে মূত্রথলিতে জীবাণুর বাসা বাঁধার শঙ্কাও কমে যায়।
২. জলের পাশাপাশি তরল খাবার যেমন ফলের জুস, ডাবের জল ইত্যাদি বেশি বেশি পান করতে হবে।
৩. পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের সময় খেয়াল রাখতে হবে যে সেটি পরিষ্কার কিনা। হাই কমোড ব্যবহারের সময় সেটা ভালো করে জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে বা, যদি সম্ভব না হয় তাহলে কমোডের উপর টিস্যু পেপার বিছিয়ে নিয়ে বসতে হবে  এতে করে জীবাণু সহজে শরীরের সংস্পর্শে আসতে পারবে না।
৩. একই কাপড় না ধুয়ে বেশিদিন পরা যাবে না। প্যান্টি নিয়মিত ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কারণ অনেকদিন যাবত না ধুয়ে ব্যাবহার করলে তাতে জীবাণু বাসা বাধে এবং সংক্রমণ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
৪. প্রস্রাবের পর যৌনাঙ্গ ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।  
৫. যখনই প্রস্রাবের বেগ আসবে সাথে সাথে প্রস্রাব করা উচিত, আটকিয়ে রাখা ঠিক নয়।প্রস্রাব যদি মূত্রাশয়ে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখা হয়, তাহলে তাতে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রতি ২০ মিনিটে মূত্রস্থিত ই.কলি ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়া মানে বেশি ব্যথা।
৬. সহবাসের পরে অবশ্যই বাথরুমে যান। ব্লাডার খালি করে দেওয়াই ভালো। কেননা ইন্টারকোর্সের সময় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। সেখান থেকে বিভিন্ন ইনফেকশন হতে পারে। এছাড়াও সেক্সের সময় ব্যবহৃত গর্ভনিরোধ থেকেও সংক্রমণ হতে পারে।
৭. সর্বপোরি পার্সোনাল হাইজিন বা ব্যক্তি জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৮. ভিটামিন সি: নিয়মিত ভিটামিন সি গ্রহণ কমিয়ে দিতে পারে ইউরিনারি ইনফেকশনের সম্ভাবনা। দিনে ১০০০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি গ্রহণে শরীরে যে অম্ল উত্‍পন্ন হয়, তাতে মূত্রে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিস্তার হ্রাস পায়।
                                                                           ◆  শিশুর প্রস্রাবে সংক্রমণ ◆
আমাদের দেশে শতকরা দুই শতাংশ শিশু এ অসুখে ভোগে।শিশু একটু বড় হলে নিজের সমস্যার কথা বলতে পারে। এতে লক্ষণ বুঝতে সুবিধা হয়। ফলে বাবা-মা বুঝতে পারেন। কিন্তু সমস্যা ছোট শিশুদের বেলায়। তারা কিছু বলতে পারে না। তাই বাবা-মায়ের লক্ষণ বুঝতে খুব অসুবিধা হয়।

■ প্রস্রাবের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে করণীয়-
১. চার ঘণ্টা পর পর প্রস্রাব করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
২. প্রতিবার খাওয়ার পর ও ঘুমানোর আগে প্রস্রাব করতে হবে।
৩. সুতির প্যান্ট ব্যবহার করতে হবে। প্যান্ট ঢিলা ও হাল্কা হতে হবে।
৪. নিয়মিত শরীর  পরিষ্কার রাখতে হবে।
৫. কোষ্ঠকাঠিন্য ও ক্রিমির চিকিৎসা করাতে হবে।
৬. প্রস্রাব ও পায়খানার পর শিশুকে ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
৭. স্কুলগামী শিশুকে স্কুলের টয়লেট ব্যবহার করতে অভ্যস্ত করতে হবে।
৮. প্রচুর জল  ও তরল খাবার খাওয়াতে হবে।

     এই রোগটি সম্পূর্ণ ব্যক্তি জীবনের লাইফস্টাইলের উপর নির্ভরশীল। এতে প্রথম দিকে তেমন কোন সমস্যা না হলেও বারবার হতেই থাকলে ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে যে কারো জীবনে। তাই সময় থাকতেই নিজের যত্নে সচেতন হন।

Comments

Popular Posts