গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা হলে কি করণীয়



●গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা-
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা একটি খুবই পরিচিত শারীরিক অবস্থা যা বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঘটছে। গর্ভাবস্থায়, বাড়তে থাকা ভ্রূণের সাথে সাথে মাকেও পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য এবং  অক্সিজেন সরবরাহ করতে রক্তের উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। অতিরিক্ত রক্ত কণিকা তৈরি করার জন্য বেশি লৌহজাত পদার্থ (যা হিমোগ্লোবিন প্রস্তুতিতে প্রয়োজন) এবং অন্যান্য পোষক পদার্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, যদি শরীরে প্রয়োজনীয় লৌহপদার্থ এবং অন্যান্য গঠনকারী পদার্থ না থাকে যেগুলির প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে অতিরিক্ত এই প্রয়োজনীয়তা পরিপূরণ হবে না, ফলে গর্ভাবস্থার অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দেয়।গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা অকালীন বা অসময়ে জন্মদান, জন্মের পর শিশুর কম ওজন, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু (শিশুর মায়ের মৃত্যু) ঘটাতে পারে।
বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ গর্ভবতী মহিলা আজ অ্যানেমিয়ার শিকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে, “অ্যানেমিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল পুষ্টির অভাব, বিশেষত আয়রনের অভাব, যদিও এই ক্ষেত্রে ফোলেট, ভিটামিন বি১২ এবং এ-এর অভাবও গুরুত্বপূর্ণ; হিমোগ্লোবিনোপ্যাথি; এবং সংক্রামক রোগ, যেমন ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভি এবং পরজীবী সংক্রমণ।”
●রক্তস্বল্পতা কী
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ যদি ১১ দশমিক ০ গ্রাম/ডেসি লিটারের কম থাকে, তাহলে তাকে গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা বলে।
সাধারণত পুরুষ ও নারীর শরীরে এই হিমোগ্লোবিনের একটা স্বাভাবিক মাত্রা আছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ১৩.৮ থেকে ১৭.২ গ্রাম/ ডেসিলিটার, আর মহিলাদের ১২.১ থেকে ১৫.১ গ্রাম/ ডেসিলিটার। হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যদি এই পরিমাণের থেকে কমে যায় তাহলেই রক্তল্পতা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।  যদি দেখা যায় কারও শরীরে প্রতি ১০০ মিলিলিটার রক্তে ১১ গ্রাম বা তার কম পরিমাণে হিমোগ্লোবিন আছে, তাহলে তাকে অ্যানিমিক বলা যাবে।
●কেন হয়
গর্ভকালীন সময়ে বিভিন্ন কারণে রক্তস্বল্পতা হয়। যেমন - 
১. আয়রনসমৃদ্ধ খাবার, আমিষ জাতীয় খাবার অথবা ভিটামিনের (ভিটামিন বি১২/ ফলিক অ্যাসিড) অভাব হলে। 
২. গর্ভকালীন সময়ে রক্তক্ষরণ হলে। গর্ভাবস্থায় যেসব কারণে রক্তক্ষরণ হয় সেগুলো হলো - গর্ভপাত, গর্ভফুল ছিঁড়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক স্থানে থাকা। কৃমি আরেকটি অন্যতম কারণ। প্রতিটি কৃমি প্রতিদিন শূন্য দশমিক ২৫ মিলি লিটার পর্যন্ত রক্ত শোষণ করতে পারে। এছাড়া রক্ত আমাশয়, এনাল পাইলস থেকেও রক্তক্ষরণ হয়। গর্ভাবস্থায় এনাল পাইলস আরো তীব্র হতে পারে।
 ৩. রক্তকণিকা বা হিমোগ্লোবিনে বংশানুক্রমিক কোনো সমস্যা থাকলে।
 ৪. সংক্রমণ বা ইনফেকশনের কারণে, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা এমনকি মূত্রথলির সংক্রমণের কারণেও রোগী রক্তস্বল্পতায় ভুগতে পারে। 
৫. এছাড়া গর্ভাবস্থা নিজেই রক্তস্বল্পতার একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রক্তে মূলত দুটি অংশ - তরল অংশ এবং কোষ ও কণিকা। গর্ভকালীন সময়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তরল অংশ বৃদ্ধি পায় প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ এবং লোহিত কণিকা বৃদ্ধি পায় মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। এই অসামঞ্জস্যতা স্বাভাবিকভাবেই গর্ভাবস্থায় রক্তস্বল্পতার একটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
● গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতার প্রকারভেদ-
1. আয়রন–ঘাটতি জনিত রক্তাল্পতা:
হিমোগ্লোবিন লোহিত রক্তকণিকার একটি প্রোটিন, যা ফুসফুস থেকে সারা শরীরের অক্সিজেন বহন করে। গর্ভাবস্থায় আয়রনের ঘাটতির লক্ষণগুলি গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে বেশ সাধারণ।আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্ত ​​শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োজনীয় পরিমাণ অক্সিজেন বহন করে না। এটি মা এবং ভ্রূণ, উভয়কেই প্রভাবিত করে।
2.ফোলেট–অভাবজনিত রক্তাল্পতা:
ফোলেট হল এক ধরণের ভিটামিন বি, যা দেহের জন্য নতুন কোষ তৈরি করতে প্রয়োজন। এটি স্বাস্থ্যকর লাল রক্তকণিকা গঠনে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায়, ফোলেটের প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়। ফোলেটের অভাবের কারণে স্বাস্থ্যকর লাল রক্ত ​​কণিকার পরিমাণ হ্রাস পেতে পারে।ফোলেটের অভাবজনিত রক্তাল্পতা নিউরাল টিউবের অস্বাভাবিকতা (স্পিনা বিফিডা) এবং জন্মের কম ওজনের মতো মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।
3. ভিটামিন বি১২–র অভাবজনিত রক্তাল্পতা:
কোবালামিন বা ভিটামিন বি১২ লোহিত রক্তকণিকা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যে সকল মহিলা তাদের ডায়েটে দুধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য, ডিম, মাংস অন্তর্ভুক্ত করেন না, তারা ভিটামিন বি১২–র অভাবজনিত রক্তাল্পতায় ভোগেন। এই অবস্থায়, প্রয়োজনীয় পরিমাণে রক্তের উৎপাদনে প্রতিবন্ধক হয়।
● লক্ষণ-
ক্লান্তি ও দুর্বলতা
মাথা ঘোরা
শ্বাস–প্রশ্বাসের দুর্বলতা
ফ্যাকাশে ত্বক
দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
বুক ব্যথা
ঠান্ডা হাত পা
রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা বা চুলকানির সমস্যা।
●মা ও গর্ভস্থ শিশুর জন্য রক্তস্বল্পতার জটিলতা
অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতা অর্থাত্‍ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭ শতাংশ গ্রামের কম হলে মা এবং গর্ভস্থ শিশুর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন মায়ের ক্ষেত্রে - প্রি-একলাম্পসিয়া, কার্ডিয়াক ফেইলর, সংক্রমণ, প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। সন্তানের ক্ষেত্রে - গর্ভস্থ শিশুর পর্যাপ্ত বৃদ্ধি না হওয়া, নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হয়ে যাওয়া, কম ওজনের শিশু জন্ম নেয়া ইত্যাদি।
●যেসব অভ্যাস বদলাতে হবে
১. খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে–পরে চা, কফি, কোনো কোমল পানীয় খেলে খাবারের আয়রন শরীরে ঠিকভাবে শোষিত হতে পারে না। তাই অভ্যাস বদলে ফেলুন।
২. খালিপেটে ফল খাবেন না। ফলের ভিটামিন সি খাবারের আয়রনকে শোষিত হতে সাহায্য করে। 
৩. ইসবগুল খান খাবার খাওয়ার ঘণ্টা দুয়েক আগে বা পরে।  না হলে ফাইবারের ছাঁকনিতে পুষ্টির বেশ কিছুটা আটকে যেতে পারে।
৪. জাঙ্ক ফুড হল মুখরোচক খাবার হলেও কোনো পুষ্টিগুণ নেই। এছাড়া বেশি খেয়ে পেটের গোলমাল হলে আরেক সমস্যা। 
৫. মাছ, মাংস ও ডিম খাওয়ার পর দুধের খাবার খাওয়া ঠিক নয়।
৬. রেড মিট, মাছ বিশেষ করে কুচো চিংড়ি, ডিম, মেটে ইত্যাদিতে আছে হিম–আয়রন। যা সহজে শরীরের কাজে লাগে। আর দুধ ও দুধে তৈরি খাবার, সবুজ শাক-সব্জি, মুসুর ও অন্যান্য ডাল, বিন, পাস্তা, ফল, বাদাম, ফর্টিফায়েড ব্রেকফাস্ট সিরিয়ালে থাকে নন–হিম আয়রন, যা সহজে শোষিত হতে পারে না। তবে সঙ্গে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার যেমন- লেবু, কমলা, আমলকী বা অন্য টক ফল খেলে শোষণের হার বাড়ে।
৭.প্রতিদিন এক চা চামচ মধু আর এক চা চামচ ভিনেগার খাওয়ার অভ্যাস করুন। আপনি চাইলে এই সবগুলো একসাথে মিশিয়েও খেতে পারেন। মধুতে যথেষ্ট পরিমাণে আয়রন, মেঙ্গানিজ, কপার আছে।
৮. প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ভিটামিন বি ১২ আর ফোলেট সমৃদ্ধ খাবার রাখুন। কমলা, কলা, মটরশুঁটি, দুদ্ধজাত খাদ্য, ডিম এইগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন বি১২ আর ফোলেট আছে।
৯. অ্যানিমিয়ার রোগীর জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিতে সবচেয়ে উপকারী চিকিৎসা হলো হাত, পা ম্যাসাজ করা। এতে করে শরীরে রক্ত চলাচল সঠিক উপায়ে হবে।
১০. আয়রন দিয়ে বানানো পাত্রে রান্না করার চেষ্টা করুন। এটা প্রমাণিত হয়েছে এসব পাত্রে রান্না করা খাবারে আয়রনের পরিমাণ অনেকখানি বেড়ে যায়।
১১.এক কাপ আপেলের জুসের সাথে এক কাপ বিট রুটের জুস আর চিনি মিশিয়ে প্রতিদিন একবার করে খান।
১২.আপেল আর টমেটোর জুসও অ্যানিমিক রোগীর জন্য ভালো।
  আসলে অ্যানিমিয়া সারাবার মুল মন্ত্রতন্ত্র খাবারের মধ্যেই নিহিত আছে। আপনি যদি রক্তশূন্যতায় ভুগেন তাহলে সবার আগে নজর দিবেন আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। আর চেষ্টা করবেন অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর এর প্রতিকার না খুঁজে প্রথম থেকেই এর প্রতি প্রতিরোধ গড়ে তোলার। কারণ একবার কোন অসুখ বিসুখে জড়িয়ে গেলে তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সত্যি অনেক কষ্টকর।

Comments